December 31, 2025, 8:45 pm

দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
২০২৫ সালে দেশে মব সন্ত্রাস গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের রূপ নিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, চলতি বছরে মব সহিংসতার শিকার হয়ে অন্তত ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন। আগের বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১২৮ জন।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৫: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আসকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ এবং সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে মব সন্ত্রাসে কমপক্ষে ২৯৩ জন নিহত হয়েছেন। এই সহিংসতায় নারী, পুরুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বহু মানুষ প্রাণ হারান। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা ও বাউল সম্প্রদায়ের সদস্যদের হেনস্তা, মারধর এবং অপমানজনক আচরণের ঘটনাও ঘটেছে।
জেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ঢাকায় মব সহিংসতায় নিহত হন ২৭ জন, গাজীপুরে ১৭ জন, নারায়ণগঞ্জে ১১ জন, চট্টগ্রামে ৯ জন এবং কুমিল্লায় ৮ জন। ময়মনসিংহ, বরিশাল, নোয়াখালী, গাইবান্ধা ও শরীয়তপুরে নিহত হন ৬ জন করে। লক্ষ্মীপুর ও সিরাজগঞ্জে ৫ জন করে এবং নরসিংদী ও যশোরে ৪ জন করে প্রাণ হারান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে গণপিটুনির ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৭ জন ছিলেন সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, নারী ছিলেন ৩ জন এবং একজন ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। এতে সামাজিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতার অসম প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে।
আসকের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, রাজনৈতিক ভিন্নমত, ধর্মীয় উগ্রবাদ, গুজব এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মব সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ‘তওহীদী জনতা’ নাম ব্যবহার করে ইতিহাস ও শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় ভাঙচুর, নারী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের হেনস্তার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ৩৮টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, যৌথ বাহিনীর হেফাজত এবং তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ‘গুলিতে’ ২৬ জন নিহত হন। থানায় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে অন্তত ১২টি। আগের বছর বিচারবহির্ভূত হত্যায় নিহত হয়েছিলেন ২১ জন।
একই সময়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে কমপক্ষে ১০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে হাজতি ছিলেন ৬৯ জন এবং কয়েদি ৩৮ জন। সর্বাধিক ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
প্রতিবেদনে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে পরিকল্পিত হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়। এতে সাংবাদিক ও কর্মীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন এবং দুটি পত্রিকার মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
আসক জানায়, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ মানবাধিকার হিসেবে রয়ে গেছে। ভিন্নমত প্রকাশের কারণে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ, মামলা ও গ্রেপ্তারের আশঙ্কা গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে দেশে ৪০১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১০২ জন নিহত এবং প্রায় ৪ হাজার ৮৪৪ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে ৩৮১ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন। এদের মধ্যে তিনজন সাংবাদিক নিহত হন এবং চারজনের মরদেহ রহস্যজনকভাবে উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া, চলতি বছরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত ৪২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বসতঘরে অগ্নিসংযোগ, মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর ও জমি দখলের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় একজন নিহত এবং অন্তত ১৫ জন আহত হন। একই সময়ে একটি বৌদ্ধ মন্দিরেও হামলার ঘটনা ঘটে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মব গঠন করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিত হামলা, হত্যা, ভাঙচুর ও লুটপাট দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও গভীরভাবে উদ্বেগজনক করে তুলেছে।